নারীবাদী উপন্যাসে মিসেস বেনেট

নারীবাদী উপন্যাসে মিসেস বেনেট : নারীবাদ (feminism) তুলনামূলকভাবে একটি ধারণা এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে জেন অস্টেন যখন তাঁর উপন্যাসগুলি লিখেছেন, নারীবাদের ধারণাটি তখন অপ্রচলিত। কিন্তু জেন অস্টেনের উপন্যাসে এক ধরনের নারীবাদের ছাপ সুস্পষ্ট। বলা হয়েছে ইংরেজী উপন্যাসের নারীকরণ (feminization of the English novel)-এর সূত্রপাত জেন অস্টেনের উপন্যাসেই।

নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-সংশ্লিষ্ট বিষয় তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। জেন অস্টেনের ছ’টি উপন্যাসেই দেখি প্রধান চরিত্ররা সুন্দরী তরুণী, যারা বিয়ের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছে যোগ্য পুরুষের। তাদের এই মনোভাবে তৎকালীন এক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে, কারণ নারীরা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-মায়ের সম্পত্তির অংশীদার হতে পারত না।

নারীবাদী উপন্যাসে মিসেস বেনেট

অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য তাদের একমাত্র ভরসা সম্পদশালী এক স্বামী। জেন অস্টেনের অন্যতম প্রধান উপন্যাস Pride and Prejudice-এর কেন্দ্রবিন্দুতে সামাজিক এই সমস্যাটি তুলে ধরা হয়েছে এবং বেনেট পরিবারের অবিবাহিতা পাঁচ মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ব্যাকুল মিসেস বেনেট অতি বাস্তববাদী একটি চরিত্র, যদিও তাঁর ধ্যান-ধারণা ও আচরণ উপন্যাসে হাস্যরসের অন্যতম উৎস।

বেনেট পরিবারের পাঁচ মেয়ে ও তাদের বাবা-মাকে ঘিরেই Pride and Prejudice-এর কাহিনী আবর্তিত। অপূর্ব সুন্দরী কিন্তু স্বল্পবুদ্ধির মিসেস বেনেট পাঁচ মেয়ের বিয়ে দেয়াকেই তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে মনে করেন।

[ নারীবাদী উপন্যাসে মিসেস বেনেট ]

পরিবারে কোন পুত্র সন্তান না থাকায় প্রচলিত ব্যবস্থায় তাঁদের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে নিকটতম কোন পুরুষ আত্মীয়। সে আশঙ্কায় নিদারুণ মর্মবেদনায় কষ্ট পান মিসেস বেনেট। মেয়েদের জন্য স্বামীর অন্বেষণই তাঁর জীবনের প্রধান কাজে পরিণত হয়। উপন্যাসের শুরুতেই দেখি, মি. বেনেটকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন এ উদ্দেশ্যেই : “জানো, নেদারফিল্ড পার্ক শেষ পর্যন্ত ভাড়া হয়েছে?”

তাঁর স্বল্পভাষী স্বামী এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন না করায় মিসেস বেনেটের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা : “তুমি কি জানতে চাওনা কে ভাড়া নিয়েছে?”

মি. বেনেটের ছোট্ট জবাবের মধ্যে রয়েছে উপন্যাসের প্রথম হাস্যরসের ছাপ : “তুমি যখন বলতে চাও, আমার শুনতে আপত্তি নেই।”

মিসেস বেনেটের জন্য এটুকুই যথেষ্ট আমন্ত্রণ। তিনি জানান, মিসেস লং বলেছেন, উত্তর-ইংল্যান্ডের এক ধনী যুবক ওটা ভাড়া নিয়েছে। সোমবার খোলা গাড়ীতে এসে সে বাড়ী দেখেছে এবং এত পছন্দ হয়েছে যে মি. মরিসের সঙ্গে সবকিছু ঠিক করে গেছে। আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে তারা এসে যাবে।

নাম তার বিংলী।

মি. বেনেটের প্রথম প্রশ্ন : “সে কি বিবাহিত না অবিবাহিত?”

মিসেস বেনেটের উচ্ছ্বসিত জবাব: “ওহ্, নিশ্চিতভাবে অবিবাহিত এক সম্পদশালী, বছরে উপার্জন চার বা পাঁচ হাজার পাউন্ড। আমাদের মেয়েদের জন্য কি চমৎকার!”

মি. বেনেটের বিস্মিত প্রশ্ন: “কি ভাবে, মেয়েদের সঙ্গে তার কি যোগাযোগ?” আনন্দে উদ্বেলিত মিসেস বেনেটের জবাব : “তুমি কেন যে বিরক্তিকর সব প্রশ্ন কর? বুঝতেই পারছ, আমি ভাবছি মেয়েদের কাউকে সে বিয়ে করবে।”

মি. বেনেটের পরবর্তী প্রশ্নে আবার হাস্যরস :

সেই ফন্দিতেই বুঝি সে এখানে আসছে?

ফন্দি। কি বোকার মত কথা বলছ? এমনতো হতে পারে, সে মেয়েদের একজনের প্রেমে পড়ে যাবে, অতএব, সে ওখানে আসা মাত্রই তুমি দেখা করে আসবে।

মি. বেনেটের হাস্যরসের শেষ নেই।

তার কোন প্রয়োজন দেখছি না। তুমিই মেয়েদের নিয়ে যেতে পার। অথবা ওদের নিজেদেরও পাঠাতে পার। সেটাই বেশী ভাল হবে, কারণ যেহেতু তুমি যে কোন মেয়ের মতই সুন্দরী, বিংলী সবার মধ্যে তোমাকেই পছন্দ করে বসতে পারে।

মি. বেনেটের রসিকতার জবাবে মিসেস বেনেট কিন্তু বেশ সিরিয়াস : “আমাকে বুঝি তোষামোদ করছ। অবশ্যই আমি সুন্দরী, তবে এখন তেমন অসাধারণ আর নই। যখন পাঁচটি সাবালিকা মেয়ে ঘরে থাকে সে মায়ের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবনা বাদ দেয়াই উচিত।”

তৎকালীন সামাজিক বিধি নিষেধের কারণে অবিবাহিতা মেয়েদের নিয়ে মায়ের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা মিসেস বেনেটের চোখে প্রতিফলিত। তিনি বারবার স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দেন বিংলীর সঙ্গে পরিচিত হবার ব্যাপারটি।

তোমার মেয়েদের কথা বিবেচনায় রেখ। ভেবে দেখ, তাদের একজনের জন্য কেমন প্রতিষ্ঠিত সংসার হবে এটা। স্যার উইলিয়াম আর লেডি লুকাস তো যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যদিও নবাগত কারো সঙ্গে তাঁরা মেলামেশা করেন না। অবশ্যই তুমি যাবে, কারণ তুমি পরিচিত না হলে আমাদের তার সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ হবে?

উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখি একই প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে। বিংলীর সঙ্গে যাঁরা দেখা করেছেন মি. বেনেট তাঁদের প্রথম সারিতে। বিংলীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা তাঁর প্রথম থেকেই ছিল, যদিও স্ত্রীকে বলেছেন যাবেন না। আবার দেখা করে ফিরে আসার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত স্ত্রীকে কিছুই বলেননি। দ্বিতীয় মেয়ে এলিজাবেথ উপন্যাসের নায়িকা এবং তাঁর প্রতি বাবার পক্ষপাতমূলক আচরণে মিসেস বেনেট ক্ষুব্ধ। সন্ধ্যায় এলিজাবেথকে ক্যাপ পরিস্কার করতে দেখে মি. বেনেটের মন্তব্য: “আশা করছি, তোমার ক্যাপ মি. বিংলীর পছন্দ হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে মিসেস বেনেটের প্রত্যুত্তর : “তার সঙ্গে দেখাই হলনা, কিভাবে আমরা জানব তার পছন্দের কথা?”

এলিজাবেথ মাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, “মিসেস লং কথা দিয়েছেন, অনুষ্ঠানে তিনি বিংলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন।”

মিসেস বেনেটের জবাব নেতিবাচক: “মিসেস লং তেমন কিছু করবেন বিশ্বাস করিনা। তাঁর নিজের রয়েছে দুই ভাগনী। স্বার্থপর এক ভণ্ড তিনি। তাঁর ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।”

“আমারও নেই,” বললেন মি. বেনেট, “তবে এটা দেখে আমি খুশী যে নিজের কাজের ব্যাপারে তুমি তাঁর ওপর নির্ভর করনা।”

কোন জবাব দেবার ইচ্ছা ছিল না মিসেস বেনেটের। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে উপস্থিত এক মেয়েকে তিরস্কার করলেন: “কিটি, ওভাবে আর কাশবে না, স্বর্গের দোহাই, আমার স্নায়ুর প্রতি একটু দয়া কর। তুমি তা ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছ।”

মি. বেনেট যোগ করলেন : “কাশি দেয়ায় কিটির কোন দোষ নেই, শুধু অসময়ে দিয়ে ফেলেছে।” ক্রুদ্ধ কিটির জবাব: “মজা করার জন্য কাশছি নাকি?”

প্রসঙ্গ পালটাতে মিসেস বেনেট এলিজাবেথের কাছে জানতে চান অনুষ্ঠানের দিন সম্পর্কে। মন্তব্য করেন, “ঐ দিনের মধ্যে যদি মিসেস লং না ফিরে আসেন তাহলে তিনিই বা কিভাবে পরিচয় করাবেন, কারণ তিনি নিজেইতো বিংলীকে চিনবেন না।”

মি. বেনেটের স্বভাবসুলভ উক্তি : “তাহলে প্রিয়তমা, তোমার বন্ধুর চেয়ে তোমারই বাড়তি সুবিধা হবে। বিংলীকে তুমিই তার সঙ্গে পরিচয় করে দিও।”

মিসেস বেনেটের তীব্র প্রতিবাদ: “এটা অসম্ভব, মি. বেনেট, অসম্ভব।

নিজেই এখনও তার সঙ্গে পরিচিত হলাম না। তুমি এত ক্ষেপাতে পারো?”

সাহিত্যে নারীজীবনের রূপায়ণ

একটু পরেই মি. বেনেট আবার বিংলীর প্রসঙ্গ তুললে মিসেস বেনেট বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “বিংলীর ব্যাপারে আমি ক্রুদ্ধ।” জবাবে মি. বেনেটের স্বভাবসুলভ রসিকতা : “তা জেনে আমি দুঃখিত। একথা আগে আমাকে বলনি কেন? এমনকি আজ সকালেও যদি তা জানতাম, আমি অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করতাম না। এটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, তবে যেহেতু দেখা করেই ফেলেছি, পরিচিতিকে অস্বীকার করি কিভাবে?”

এ কথায় মেয়েদের বিশ্বয়ের মাত্রা মি. বেনেটের প্রত্যাশা মতই হল। মিসেস বেনেটের বিস্ময় অবশ্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। আনন্দের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, এমনটি যে হবে তা তিনি সবসময় আশা করেছেন। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন : “কি ভাল তুমি, মি. বেনেট। জানতাম তোমাকে রাজি করাবই। আমি নিশ্চিত, মেয়েদের তুমি এত ভালবাস যে একটা পরিচিতির সুযোগ তুমি অবহেলা করবে না। কি আনন্দ আমার। আর এমন মজার ব্যাপার, তুমি আজ সকালেই দেখা করলে, কিন্তু সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছুই বললেনা।” সামাজিক বিধি নিষেধের কারণে মেয়েদের অসহায়তার ব্যাপারটি এখানে প্রতিফলিত।

এই উপন্যাসে মিসেস বেনেট উপস্থাপিত হয়েছেন এমন এক মায়ের অবয়বে মেয়েদের প্রয়োজনে সবকিছু করা যাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব। জেন অস্টেন প্রথম অধ্যায়ে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “হাল্কা বুদ্ধি, স্বল্পজ্ঞান ও অনিশ্চিত মেজাজের মহিলা তিনি। অসন্তুষ্ট হলে কল্পনা করেন তিনি নার্ভাস। তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন মেয়েদের বিয়ে দেয়া …।” যখন জানা গেল বিংলী এক নাচের আসরের আয়োজন করবে, মিসেস বেনেটের আনন্দের শেষ নেই, কারণ নাচ পছন্দ করা প্রেমে পড়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ।

আমার এক মেয়েকে যদি নেদারফিল্ডে সুখী জীবনযাপন করতে দেখি, আর অন্যান্যদের তেমনভাবেই বিবাহিত, আমার চাওয়ার আর কিছুই থাকবে না,”

অকপটে স্বামীকে বলেন মিসেস বেনেট। বিংলী এক সংক্ষিপ্ত সফরে বেড়াতে এলে মিসেস বেনেট তাকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান এবং ভোজের বিভিন্ন আয়োজন সম্পর্কে ভাবেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বিংলী আমন্ত্রণ গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে হতাশ হন মিসেস বেনেট। পরবর্তীতে মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান তিনি এবং ফিরে এসে স্বামীকে বলেন : “প্রিয়তম, মি. বেনেট, অতি চমৎকার সন্ধ্যা কাটিয়েছি আমরা। ইস্, তুমি যদি থাকতে। জেনকে সবাই এত প্রশংসা করেছে…

বিংলী জেনকে বেশ সুন্দরী মনে করেছে এবং দু’বার তার সঙ্গে নাচে অংশ নিয়েছে। ভেবে দেখ ব্যাপারটা, প্রিয়তম। সে তাঁর সঙ্গে আসলে দু’বারই নেচেছে। ঐ রুমে জেনই একমাত্র যাকে সে দ্বিতীয়বার নাচে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে সে মিস লুকাসকে আমন্ত্রণ জানায়। ঐ মেয়ের সঙ্গে তাকে দেখে আমি যা ক্ষেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে তাকে কোন প্রশংসাই করেনি। আসলে কেই বা করতে পারে। আর জেনের সঙ্গে নাচার সময় সে তো ভীষণ মুগ্ধ।

জিজ্ঞাসা করল তার পরিচয় এবং পরবর্তী দুটো নাচে তার সঙ্গে অংশ নিয়েছে।” মিসেস বেনেট যখন অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে বিংশীর নাচের বৃত্তান্ত দিচ্ছিলেন, মি. বেনেট রসিকতা করে বললেন: “যদি আমার জন্য তার বিন্দুমাত্র অনুভূতি থাকত, তাহলে সে এর অর্ধেক পরিমাণেও নাচত না। খোদার দোহাই, তার নাচের সঙ্গীদের কথা আর বলবে না। ইস্, প্রথম নাচেই যদি তার পা ভেঙ্গে যেত।”

মেয়েদের বিয়ের সম্ভাবনায় মিসেস বেনেটের কোন কোন আচরণ অনেক সময় অস্বাভাবিকভাবে নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন। ক্যারোলীন বিংলী এক পত্রে জেনকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানায়। জেন জানতে চায় সে পারিবারিক গাড়ীটি নিয়ে যাবে কিনা। মিসেস বেনেটের স্পষ্ট জবাব না, তুমি বরং ঘোড়ায় চড়ে যাও, কারণ বৃষ্টি হবার দারুণ সম্ভাবনা এবং সারারাত অবশ্যই তুমি সেখানে থাকবে।” এলিজাবেথের টিপ্পনী: “এটা ভালো পরিকল্পনা তবে ওরা যদি তাকে আবার বাড়ী ফেরত না পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তা সম্ভব হবে না, কারণ বিংলীর গাড়ী নিয়ে অন্যরা মেরিটনে যাচ্ছে। অন্যদের ঘোড়া নেই।”

জেন তবুও বলে, “গাড়ীতেই বরং যাই।” মিসেস বেনেটের অজুহাত : “কিন্তু তোমার বাবা তো গাড়ী দিতে পারবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।” শেষ পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়েই জেনের যাত্রা শুরু। খারাপ আবহাওয়া নিয়ে মিসেস বেনেট ভবিষ্যৎ বাণী করলেন এবং তাঁর ইচ্ছেই পূর্ণ হল। জেন বেশী দূর যাবার আগেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। অন্যান্য বোনেরা আশঙ্কিত হলেও মায়ের খুশীর শেষ নেই। বার বার তিনি বলতে লাগলেন, “কি সৌভাগ্যের দিন আমার।”

ভাবখানা এমন যে বৃষ্টি হবার কৃতিত্বটুকু যেন তাঁরই। মুষলধারে সারা সন্ধ্যা বৃষ্টি হল। পরদিন সকালেই জেনের চিঠি এল, বৃষ্টিতে ভিজে তার গলায় ব্যথা ও মাথায় যন্ত্রণা। চিঠির বিষয়বস্তু জেনে মি. বেনেটের স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা : “প্রিয়তমা, তোমার মেয়ের যদি মারাত্মক অসুখ হয়, যদি সে মরেও যায়, তবু এটা জেনে স্বস্তি পাব যে তা ঘটেছে বিংলীকে পাওয়ার জন্য তোমার নির্দেশে।” মিসেস বেনেটের স্বভাবসুলভ জবাব : “আমি তার মৃত্যু নিয়ে আদৌ ভীত নই। সামান্য ঠাণ্ডায় মানুষ মরে না। ওখানে ভালভাবেই ওর যত্ন করা হবে।

যতদিন ওখানে থাকে, ততই ভাল।” মায়ের অবয়বে মিসেস বেনেটের এই আচরণ প্রমাণ করে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটা কতটা অপরিহার্য।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের উত্তরাধিকার না থাকার বিষয়টি দারুণভাবে পীড়িত করে মিসেস বেনেটকে। এ ব্যাপারে তাঁর যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি দেখি উপন্যাসের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। মি. বেনেটের সম্পত্তির হবু উত্তরাধিকারী পাদ্রী কলিন্স এক চিঠিতে বেড়াতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে আগমণের দিন তারিখ জানিয়ে দেন। চিঠি প্রসঙ্গে মি. বেনেট বলেন:

চিঠি এসেছে আমার কাজিন কলিন্সের কাছ থেকে, যে আমার মৃত্যুর পর তার খুশীমত তোমাদের এই বাড়ী থেকে বের করে দেবে।

মিসেস বেনেটের আর্তনাদ :

“প্রিয়তম, আমি ঐ কথার উল্লেখ শুনতে পারি না। দয়া করে ঘৃণ্য ঐ লোকটির কথা বল না। পৃথিবীতে এটা নিদারুণ কষ্টের ব্যাপার যে তোমার সম্পত্তির উত্তরাধিকার তোমার সন্তানদের হবে না। আমি নিশ্চিত, আমি যদি তুমি হতাম অনেক আগেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতাম বা কিছু করতাম। মেয়েরা প্রচলিত উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা তাঁকে বোঝাতে চাইলে তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না। তিনি ঐ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। তবে কলিন্স আসার পরপরই বুঝিয়ে দেন যে বেনেট পরিবারের কোন মেয়েকে বিয়ের মাধ্যমে তিনি তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার ব্যাপারটিকে আন্তরিক করতে চান।

এটা জানার পর মিসেস বেনেটের আচরণে আসে আমূল পরিবর্তন। জেনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন কলিন্স এবং তার কথাই ভাবতে থাকেন। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে মিসেস বেনেট ইঙ্গিত দেন যে বিংলীর সঙ্গে তার বাগদান আসন্ন। মিসেস বেনেট চুলার আগুন বাড়িয়ে দিতে যেটুকু সময় নেন তার মধ্যেই কলিন্স মন পরিবর্তন করে এলিজাবেথের ব্যাপারে মনস্থির করেন। তাঁর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মিসেস বেনেট আশ্বস্ত হন যে অচিরেই তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং একদিন আগেও যে ব্যক্তির নাম তিনি শুনতে পারতেন না, এখন তিনি তাঁর অনেক পছন্দের।

বিয়ের প্রস্তাব দেবার লক্ষ্যে কলিন্স যখন এলিজাবেথের সঙ্গে আলাপের অনুমতি চান, এলিজাবেথ বিস্ময়ে রক্তিম হয়ে ওঠে। সে কিছু বলার আগেই মিসেস বেনেট সোৎসাহে বলে ওঠেন

অবশ্যই, নিশ্চয়ই, আমি জানি লিজি খুবই খুশী হবে কথা বলতে। আমি নিশ্চিত তার কোন আপত্তি থাকতে পারে না। কিটি, চল, আমরা দোতলায় যাই।

তিনি প্রস্থানে উদ্যত হলে এলিজাবেথ আপত্তি জানিয়ে বলে:

মা, যাবেন না, আমার বিনীত অনুরোধ, আপনি যাবেন না। কলিন্স ক্ষমা করবেন। তাঁর এমন কিছু বলার নেই যা অন্যরা শুনতে পারে না। আমি নিজেই চলে যাচ্ছি।

মিসেস বেনেট আর্তনাদ করে ওঠেন:

না, না, বোকামি করবেনা লিজি, আমি চাই তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাকবে।

ঘরের মধ্যে কলিন্স যখন এলিজাবেথের সঙ্গে কথা বলছেন, মিসেস বেনেট পাশের ঘরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। যখনই দেখলেন এলিজাবেথকে দরজা খুলতে, তিনি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন এবং কলিন্স ও এলিজাবেথকে অভিনন্দন জানালেন তাদের আসন্ন বিয়ের সম্ভাবনায়। কিন্তু তাঁর জানা ছিল না যে এলিজাবেথ কলিঙ্গের বিয়ের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই প্রত্যাখ্যান করেছে। সে ঘটনা জানার পর তিনি কলিন্সকে আশ্বস্ত করছেন,

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, লিজিকে আমরা বোঝাব, সরাসরি আমি নিজেই এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলব। সে একগুয়ে বোকা মেয়ে, নিজের স্বার্থ বোঝে না, আমি তাকে বুঝিয়ে ছাড়ব।

পরবর্তীতে, মিসেস বেনেট লাইব্রেরীতে তাঁর স্বামীর কাছে চলে যান : “মি. বেনেট, তোমাকে বড্ড প্রয়োজন। একটা ঝামেলায় পড়েছি। তুমি এসে কলিন্সকে বিয়ে করতে বল লিজিকে, কারণ সে প্রতিজ্ঞা করেছে কলিন্সকে বিয়ে করবে না। তুমি তাড়াহুড়া না করলে কলিঙ্গ মন পাল্টে ফেলবে ও লিজিকে বিয়ে করবে না। মি. বেনেট চিরাচরিত রসিকতার মধ্য দিয়েই ব্যাপারটি মোকাবেলা করেন। এলিজাবেথকে বলেন,

তোমার সামনে আজ এক দুর্ভাগ্যজনক বিকল্প এলিজাবেথ, আজ থেকে তোমার মা অথবা বাবার কাছে তুমি আগন্তুক হয়ে যাবে। তোমার মা তোমাকে আর দেখা দেবেন না যদি তুমি কলিন্সকে বিয়ে না কর। আর আমি তোমাকে দেখা দেব না যদি তাকে বিয়ে কর।

স্বামীর কথায় বিস্মিত হলেও মিসেস বেনেট বারবার বোঝাতে লাগলেন এলিজাবেথকে, পর্যায়ক্রমে আদর ও ধমক দিয়ে। জেনকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে বললেন, যদিও সে শান্ত ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে। এলিজাবেথের বান্ধবী পাশের বাড়ীর শার্লটকে তখন বিলাপের সুরে বললেন,

তুমি একটু বোঝাও, আমার পক্ষে কেউ নেই, কেউ আমাকে সাহায্য করেনা, আমার সঙ্গে সবাই নিষ্ঠুর আচরণ করে, আমার কষ্ট কেউ বোঝে না।

পরবর্তীতে শার্লটের সঙ্গে কলিন্সের বিয়ের কথা জেনে মিসেস বেনেটের অনুভূতি লক্ষ্যণীয়। প্রথমে তিনি চিৎকার করে বলেন, “কলিঙ্গের সঙ্গে বাগদান হয়েছে শার্লটের, অসম্ভব!”

শার্লটের বাবা স্যার উইলিয়াম যখন খবরটি দিতে আসেন, মিসেস বেনেট প্রতিবাদ করেন:

হায় বিধাতা! স্যার উইলিয়াম, আপনি কিভাবে এসব কথা বলেন? আপনি কি জানেন না যে মি. কলিঙ্গ লিজিকে বিয়ে করতে চায়?

স্যার উইলিয়ামের উপস্থিতিতে মিসেস বেনেট এতটা অভিভূত ছিলেন যে বেশী কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু যখনই তিনি চলে গেলেন, তাঁর অনুভূতির প্রকাশে বিস্ফোরণ ঘটল। প্রথমত, তিনি পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস করতে চাইলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি নিশ্চিত হলেন যে মি. কলিন্সকে প্রতারিত করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, তাঁর বিশ্বাস এ দম্পতি কখনই সুখী হবে না এবং চতুর্থত, এ বিয়ে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন কিছুতেই সান্ত্বনা পান না মিসেস বেনেট। এক সপ্তাহ পার হবার পরই তিনি এলিজাবেথকে দেখলে আর তিরস্কার করতেন না। আর এক মাস পরেই তিনি স্যার উইলিয়াম লেডি লুকাসের সঙ্গে রূঢ় না হয়ে কথা বলতে পারতেন। মেয়েদের অপারগতাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি বেশ কয়েক মাস।

সবচেয়ে ছোট মেয়ে লিডিয়া মিলিশিয়া অফিসার উইকহ্যামের সঙ্গে পালিয়ে গেলে দারুণ মুষড়ে পড়েন মিসেস বেনেট। পরে লন্ডনে তাদের খুঁজে পান মিসেস বেনেটের ভাই মি. গার্ডিনার। ওদের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হলে মিসেস বেনেটের আনন্দের শেষ নেই। পরম আদরে তিনি বরণ করেন লিডিয়া ও উইকহ্যামকে। সবচেয়ে ছোট মেয়ে মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়ে করেছে — এ ব্যাপারটাও তাঁর কাছে তৃপ্তিদায়ক।

এলিজাবেথ সম্পর্কে রূঢ় মন্তব্য করায় ডার্সির প্রতি তাঁর ক্রোধের কোন শেষ ছিল না। পরবর্তীতে এলিজাবেথ ডার্সিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানালে মিসেস বেনেট প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেন না।

ব্যাপারটি কি সত্যি? আমার অতি আদরের লিজি, কত ধনী, কত বড় ভবিষ্যত তোমার হবে। কত অলঙ্কার, কত গাড়ী তোমার থাকবে। তোমার কাছে জেন কিছুই না। আমি কত সন্তুষ্ট, কত সুখী।

নারীবাদী এই উপন্যাসের শুরু থেকে মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের বিয়ের জন্য নিবেদিত মিসেস বেনেট উপন্যাসের সমাপ্তিতে তাঁর আরাধ্য কাজ অনেকটা শেষ করেন এবং অশেষ সন্তুষ্টি ও সুখের কথা বলেন। তাঁর সুখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেয়েদের বিবাহিত জীবন ও ভবিষ্যত সুখের সম্ভাবনা। মিসেস বেনেটের চরিত্র চিত্রণে জেন অস্টেন নারীবাদী এক মায়ের প্রতিকৃতি উপস্থাপন করেছেন।

 

সহায়ক-গ্রন্থ

  • রবার্ট উইলিয়াম চ্যাপম্যান Jane Austen: Facts and Problems, অক্সফোর্ড, ১৯৪৮।
  • হাওয়ার্ড এস. বব Jane Austen’s Novels: The Fabric of Dialogue, কলম্বাস, ১৯৬২।
  • এ্যান্ড্রু এইচ. রাইট Jane Austen’s Novels: A Study of Structure, লন্ডন, ১৯৫৪
  • মেরী লেসলী: Jane Austen and Her Arts, অক্সফোর্ড, ১৯৩৯।

আরও দেখুন:

Leave a Comment