মিসেস মূর ও এ্যাডেলা : প্রেক্ষাপট সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত [ A Passage to India ]

মিসেস মূর ও এ্যাডেলা : প্রেক্ষাপট সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত : সৈয়দ আনোয়ারুল হক : ইংরেজ লেখক ই. এম. ফরস্টারের উপন্যাস A Passage to India বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত রাজনৈতিক উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসের মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে। আমেরিকান সমালোচক Lionel Trilling এই উপন্যাসকে “a political novel of an unusual kind” নামে আখ্যায়িত করেছেন।মিসেস মূর ও এ্যাডেলা : প্রেক্ষাপট সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত [ A Passage to India ]

ব্রিটিশ শাসক ও ভারতীয় শাসিতদের মধ্যেকার সংঘাতকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ফরস্টার, যখন ১৯২১ সালে তিনি ভারতীয় রাজ্য দেওয়াস স্টেটের মহারাজার সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই সংঘাতকে তিনি উপন্যাসে উপস্থাপিত করেছেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে, যদিও তিনি ব্রিটিশ শাসকদের স্বগোত্রীয় ছিলেন।

উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাসে এই সংঘাত অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে Jane Perry Levine যথার্থই মন্তব্য করেছেন : “The political aspect of the novel focuses on the racial tension.” এ কথা ঐতিহাসিক ভাবে ত্যি যে ভারতের প্রধান দু’টি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ ছিল প্রবল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ও ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক সমঝোতার সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে। Gertrude M. White এই সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে “…hatred and suspicion of the English”-কে চিহ্নিত করেছেন যা উপন্যাসের কাহিনী বিশ্লেষণে যথার্থ বিবেচিত হয়।

Lionel Trilling ব্রিটিশদের চিহ্নিত করেছেন, “arrogant ignorant, insensitive” অভিধায়। এ মন্তব্য উপন্যাসে চিত্রিত নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষতঃ ইংরেজ কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। কিন্তু উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র মিসেস মূর ও এ্যাডেলার ক্ষেত্রে এ মন্তব্য একেবারেই অযৌক্তিক। বৃদ্ধা মিসেস মূর ভারতে এসেছেন তার ছেলে নগর ম্যাজিস্ট্রেট রনিকে দেখতে। সঙ্গে এনেছেন এ্যাডেলাকে, যার সঙ্গে রনির বাগদান হয়েছে ইংল্যান্ডে। তাঁরা দুজনেই এই ভ্রমণে সত্যিকার ভারত (real India) দেখতে আগ্রহী।

সমকালীন রাজনীতির একটি অশুভ দিক হচ্ছে ভারতীয় কর্মকর্তাদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের নিপীড়নমূলক মনোভাব। উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখি প্রধান চরিত্র ভারতীয় সার্জন ডাঃ আজিজের প্রতি হাসপাতালের ব্রিটিশ সিভিল সার্জন মেজর ক্যালেন্ডারের বিদ্বেষী আচরণ। ছুটির দিনে এক বন্ধুর বাসায় ডাঃ আজিজ মিলিত হয়েছিলেন অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে, উদ্দেশ্য চটুল আড্ডা ও ভুরিভোজন। তাঁরা আলোচনা করছিলেন মৌলিক একটি প্রশ্ন : “ভারতের মাটিতে ইংরেজদের সঙ্গে কি বন্ধু হওয়া সম্ভব?” মাহমুদ আলী যুক্তি দেখালেন — তা একেবারেই অসম্ভব।

হামিদুল্লাহ সরাসরি এ বক্তব্য মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুধাবন এর কাছাকাছি। ক্যামব্রিজে শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় হামিদুল্লাহ বলেন, ইংল্যান্ডে ইংরেজরা বেশ বন্ধু ভাবাপন্ন। কিন্তু ভারতের মাটিতে শাসকদের অবয়বে তাদের আচরণ একেবারেই পাল্টে যায়। তারা সহজেই হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু ও বিদ্বেষী।

সব কিছুতেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে অনড়, যদিও তারা দূর্নীতি মুক্ত নয়। অতিথিদের একজন বর্ণনা করলেন, জেলা কালেক্টরের স্ত্রী মিসেস টারটন কিভাবে সোনার সেলাই মেশিন ঘুষ নিয়েছিলেন এক মহারাজার কাছ থেকে, তাঁর রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবিত খাল খনন করার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। তবে সে খাল ঐ রাজ্যের মধ্য দিয়ে আদৌ প্রবাহিত হয়নি।

আলোচনার মোড় ঘুরে যায় ব্রিটিশ প্রভু আর ভারতীয় অফিসারদের কর্ম পদ্ধতির ভিন্নতার দিকে : “When we poor blacks take bribe, we perform what we are bribed to perform, and law discovers us in consequence. The English take and do nothing.” আইনজীবী হামিদুল্লাহ শ্বেতাঙ্গ নগর ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্কে অভিযোগ করেন : The red-nosed boy has again insulted me in the court. . .. He was told that he ought to insult me.” অভিযোগের দ্বিতীয় অংশে ব্রিটিশ প্রভুদের উদ্ধৃত মানসিকতার প্রতিফলন সুস্পষ্ট : যেন দুর্ব্যবহারের মাধ্যমেই জানাতে হবে তাদের প্রভুত্ব।

শাসক প্রভুদের খামখেয়ালিপনা শাসিত ভারতীয়দের জন্য তাদের প্রতি নির্যাতনের ভিন্ন কৌশল। ডাঃ আজিজ যখন বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে রত, মেজর ক্যালেন্ডারের পত্রবাহক অবিলম্বে দেখা করার নির্দেশ নিয়ে হাজির। ডাঃ আজিজ এতে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ। তাঁর উচ্চারণে শোষিত ভারতীয়দের প্রতিবাদই উচ্চারিত হয় : “He has found out our dinner hour, that’s all and chooses to interrupt us every time in order to show his power.”

শাসিত ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অবজ্ঞায় তীব্র ক্ষোভ জানান ডাঃ আজিজ “(He does not ) have the politeness to say why” নামের ভিন্নতা সত্ত্বেও আচার-আচরণে ব্রিটিশ শাসকরা অভিন্ন : “They all become exactly the same, not worse, not better. I give any Englishman two years, be he Turton or Burton. It is only the difference of a letter…. All are exactly alike.”

ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি ডাঃ আজিজের ক্ষোভ শতগুণে বেড়ে যায় মেজর ক্যালেন্ডারের বাসভবনের যাত্রাপথে … depression suddenly seized him.” কারণ আজিজ লক্ষ্য করলেন, বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের স্মরণে। সমগ্র ভারত বর্ষের ওপর ব্রিটিশরা যে শাসনের বেড়াজাল ছড়িয়ে দিয়েছে এ যেন তারই প্রতীক। “The roads named after — victorious generals and intersecting at right angles, were symbolic of the net Great Britain had thrown over India.” মেজর ক্যালেন্ডারের বাসভবনের সামনে পৌঁছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায় একজন ভারতীয় কর্মচারীর অপদস্থ হওয়ার কথা মনে পড়ে যায় মানসিকভাবে পীড়িত ডাঃ আজিজের।

মিসেস মূর ও এ্যাডেলা : প্রেক্ষাপট সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত [ A Passage to India ]

ঐ ভারতীয় সরাসরি প্রবেশ করেছিলেন কর্মকর্তার বাড়ীতে, যা তাঁর ব্রিটিশ প্রভু অবমাননাকর মনে করেন। কিছুটা ইতস্তুতের পর গন্তব্যে এগিয়ে যান ডাঃ আজিজ, কিন্তু জেনে হতাশ হন মেজর ক্যালেন্ডার বেরিয়ে গেছেন আজিজের জন্য কোন বার্তা না রেখেই। দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলার সময় দু’জন ব্রিটিশ মহিলা ভবন থেকে বের হন। আজিজ ক্যাপ খুলে তাদের সৌজন্য দেখান, কিন্তু তাঁরা তা অগ্রাহ্য করে আজিজের জন্য অপেক্ষারত ঘোড়ার গাড়িতে উঠে চালককে ক্লাবে যাবার আদেশ দেন।

মহিলাদের দুর্ব্যবহারে ব্যথিত হলেও আজিজ গাড়ীওয়ালাকে তাঁদের ক্লাবে নিয়ে যেতে বলেন: “You are most welcome, ladies.” উচ্চারণ করে তিনি আবার তাঁদের প্রতি সম্মান দেখান। কিন্তু আগের মতই তা অগ্রাহ্য হয়। ক্রমাগত অবমাননার শিকার ডাঃ আজিজের ক্রোধ আবার জেগে উঠে।

ধর্মপ্রাণ মুসলমান আজিজ কাছেই এক মসজিদে চলে যান। এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে যায় তাঁর মন। চত্বরেই দাক্ষিণাত্যের এক রাজার কবর। পার্সী ভাষায় চার লাইনের এপিটাফ আজিজ গভীর মনোযোগে পড়লেন। চোখে পানি এল তাঁর। হঠাৎ মনে হল মসজিদের একটা স্তম্ভ নড়ে উঠল। তাঁর আশঙ্কা, ভূত-প্রেত নয়ত। স্থির বসে রইলেন তিনি। দ্বিতীয় তৃতীয় স্তম্ভটিও নড়ে উঠল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল এক ইংরেজ মহিলাকে। হঠাৎ ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন: ম্যাডাম! ম্যাডাম! ম্যাডাম! বিস্মিত মহিলা থ’হয়ে দাঁড়ালেন।

“ম্যাডাম এটা মসজিদ এখানে আসার কোন অধিকারই আপনার নেই; আপনার জুতা খুলে আসা উচিত ছিল; মুসলমানদের জন্য এটা পবিত্র স্থান।”

“আমি জুতো খুলে ঢুকেছি।”

“জুতা খুলেছেন আপনি?”

“প্রবেশ দ্বারে খুলে এসেছি।”

“তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন।” (২০)

এমন নাটকীয়ভাবেই মিসেস মূরের মুখোমুখি হন ডাঃ আজিজ। কিছুক্ষণ আগে ইংরেজদের প্রতি তাঁর যে ক্রোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল সহসাই তার শিকার হন আগম্ভক মিসেস মূর। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আজিজ আবার বলেন, “এভাবে বলার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত, ” হতবাক মিসেস মূর জবাব দেন, “হ্যাঁ, আমি ঠিকই করেছি, তাই না? জুতা খুলে আমিও আসতে পারি?”

“অবশ্যই, তবে স্বল্পসংখ্যক মহিলা এ কষ্টটুকু করেন, বিশেষ করে যখন ভাবেন, দেখে ফেলার মত কেউ কাছে নেই, ” বিনীত আজিজের জবাব ।

“তাতে কিছু আসে যায় না। বিধাতা এখানে আছেন” মিসেস মূরের শান্ত জবাব ।

দুর্ব্যবহারের জন্য আজিজের মনে অনুশোচনা হয়, বৃদ্ধাকে খুশী করার উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার জন্য কিছু করতে পারি, এখন বা যে কোন সময়ে?”

নেতিবাচক জবাব দেন তিনি। আজিজ তাঁর নাম জানতে চান।

তিনি জবাব দেন, “মিসেস মূর।”

তাঁদের আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কিছুটা হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। আজিজ তাঁকে রাতে একাকী চলতে নিষেধ করেন। ভয় রয়েছে চিতাবাঘ ও সাপের। মিসেস মৃর জিজ্ঞাসা করেন : “তুমি নিজেইত হাঁটা চলা কর।” আজিজ বলেন, “আমি তাতে অভ্যস্ত।” মিসেস মূরের বিস্মিত জিজ্ঞাসা, “সাপের সঙ্গে অভ্যস্ত?” দুজনেই হেসে ওঠেন। অন্তরঙ্গতায় আরো কিছু আলাপ করেন তাঁরা।

লিওনেল ট্রিলিং ব্রিটিশ শাসকদের “arrogance” এবং “ignorance” সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন জেলা কালেক্টরের উদ্যোগে ক্লাবে অনুষ্ঠিত ব্রিজ পার্টিতে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। শাসক ও শাসিতের এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ: প্রথমত, ভারতে নবাগত মিসেস মূর ও এ্যাডেলাকে ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিয়ে ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া। দ্বিতীয় কারণটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নিঃসন্দেহে : শাসক শাসিতের মধ্যে দূরত্ব কমানো।

অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তা হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। শাসকদের প্রতি স্বদেশীদের আস্থার এতই অভাব যে মাহমুদ আলী বিশ্বাসই করতে চান না জেলা কালেক্টর স্বেচ্ছায় ঐ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন : “Turton would do this unless compelled” তাঁর ধারণা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নির্দেশেই জেলা কালেক্টর ঐ অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হয়েছেন।

মাহমুদ আলীর মনোভাবের সঙ্গে একমত অনেকেই, এমনকি ডাঃ আজিজও। তাঁরা সমবেতভাবে ঐ অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। মুষ্টিমেয় যাঁরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন তাঁরা অবহেলিত ভাবে টেনিস লনের একান্তে দাঁড়িয়ে থাকেন। ব্রিটিশ শাসকদের কয়েকজন অকপটে তাঁদের দাম্ভিকতা প্রকাশ করেন অনুষ্ঠানে এবং বলেন, নবাব বাহাদুর খেতাবধারী ছাড়া অন্য ভারতীয়দের সঙ্গেমিসেস মুর ও এ্যাডেলা প্রেক্ষাপট সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত তাঁরা করমর্দন করবেন না: refuse to shake hands with any of the men, unless it has to be the Nowab Bahadur.”

জেলা কালেক্টরের স্ত্রী মিসেস টারটন ভারতীয়দের উপস্থিতি লক্ষ্য করে বলেন : “Why they come at all I don’t know. They hate it as well as we do….. .” শাসক-শাসিতের মধ্যে সংঘাত এতই প্রকট যে এ ধরণের পুনর্মিলনী উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। ভিন্ন মন-মানসিকতার মিসেস মূর ভারতীয়দের ব্যাপারে উৎসাহ দেখালে মিসেস টারটন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন : “You’re superior to them, any way. Don’t forget that you’re superior to every one in India.”

ভারতীয়দের সম্পর্কে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক মন্তব্য আসে সিভিল সার্জনের স্ত্রী মিসেস ক্যালেন্ডারের কাছ থেকে। তাঁর মতে, ভারতীয়দের মরতে দেয়াই তাদের প্রতি চরম দয়া দেখানো “… the kindest thing one can do is to let him die.” তথাকথিত বর্বরদের মধ্যে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেয়ার ব্রতধারী উপনিবেশবাদীদের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হয় ঐ সকল মন্তব্যে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভারত শাসনের মূল উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয় সিটি ম্যাজিস্ট্রেটের উচ্চারণে। তাঁর মনোভাবে ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ জননী মিসেস মূরকে তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন “.. to do justice and keep peace… to hold this wretched country by force….”

শাসক-শাসিতের সংঘাত সৃষ্টিতে উপন্যাসে ভারতীয়দের মেধাগত উৎকর্ষ বিশেষ অবদান রাখে। ডাঃ আজিজের প্রতি সিভিল সার্জনের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ হল শল্য চিকিৎসায় ডাঃ আজিজের পারদর্শিতা। সিভিল সার্জন বিশ্বাস করেন, ডাঃ আজিজ যদি মিসেস গ্রেস ফোর্ডের এ্যাপেনডিক্স অপারেশন করতেন তাহলে ঐ বৃদ্ধা মহিলা সম্ভবত বেঁচে থাকতেন : “But in his heart he knew that if Aziz and not he had operated last year on Mrs. Graysfords appendix, the old lady would probably have lived.”

উপন্যাসের অন্যত্র দেখি কলেজের প্রিন্সিপাল ফিল্ডিং ভারতীয়দের প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল আচরণ সত্ত্বেও ডাঃ আজিজের শিল্পানুরাগকে খাটো করে দেখছেন এবং এতে তাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ফিল্ডিংয়ের বাসায় এ্যাডেলার শিল্পসম্মত গুণাবলী আলোচনা কালে ডাঃ আজিজ “Post impressionism” তত্ত্বের অবতারণা করেন। কিন্তু ফিল্ডিংয়ের মনোভাবে আজিজের ধারণা হয়, তিনি আজিজের সঙ্গে বিষয়টির আলোচনা এড়াতে চান।

কিছুটা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফিল্ডিং বলেন : “Post-Impressionism, Indeed! Come along to tea. This world is getting too much for me altogether.” ফিল্ডিংয়ের শেষ উচ্চারণটিতে তাঁর উন্নাসিক মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। ডাঃ আজিজের অনুধাবন, ফিল্ডিং যেন বলতে চান : “We, an obscure Indian, had no right to have heard of Post Impressionism-a privilege reserved for the Ruling Race ….”

A Passage to India উপন্যাসের সবচেয়ে সংঘাতময় ঘটনাটির সূচনা হয় মারাবার পাহাড়ের এক গুহায়, যা বিদ্যমান রাজনৈতিক সংঘাতকে তুঙ্গে নিয়ে যায়। মিসেস মূর ও এ্যাডেলার সত্যিকার ভারত দেখার প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে ডাঃ আজিজ তাদের সুপ্রাচীন মারাবার পাহাড়ের গুহা ভ্রমণে আমন্ত্রণ জানান। মিসেস মৃর সানন্দে তা গ্রহণ করলেও তাঁর পুত্র নগর ম্যাজিস্ট্রেট রনি এতে আপত্তি জানান। ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর একদম পছন্দ নয়।

মাকে তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দেন, ঐ ভ্রমণে যেতে হলে ব্রিটিশদের আয়োজনেই যেতে হবে, ভারতীয়দের সঙ্গে নয়: “I won’t have you messing about with Indians any more! If you want to go to the Marabar Caves you’ll go under British auspices.” রনির উন্নাসিক আচরণে শুধু মিসেস মূরই না, এ্যাডেলাও ক্ষুব্ধ। ইংল্যান্ডে যে রনিকে এ্যাডেলা চিনতেন, ভারতবর্ষের মাটিতে যেন তাঁর অপমৃত্যু ঘটেছে। অমানবিক ও নিষ্ঠুর এই তরুণ শাসকের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন তাঁর ভেঙ্গে পড়ছে।

সময়টা তখন মুসলমানদের ধর্মীয় উদ্দীপনার মহরম মাস। যে কোন মুহূর্তে চন্দ্রপুর শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হতে পারে। জেলা কালেক্টর দাঙ্গা পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য কর্মপদ্ধতি নিয়ে ব্যস্ত। দাঙ্গা পরিস্থিতিই রনির কাম্য। কারণ ব্রিটিশ শাসনের অপরিহার্যতা এমন অবস্থাতেই ধরা পড়ে : “it proved that the British were necessary to India; there would certainly have been bloodshed without them.”

ব্রিটিশ শাসকদের ত্রাণকর্তার এই ভূমিকায় ডাঃ আজিজ ক্ষুব্ধ। ফিল্ডিংকে তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেন : “… how is England justified in holding India?” ফিল্ডিং এ প্রশ্নের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পান। তবুও জবাব দেন: “I can not tell you why England is here or whether she ought to be here. It’s beyond me.” সমকালীন রাজনৈতিক সংঘাত দুই বন্ধুর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষের কারণে তাদের অবমূল্যায়ন করতেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, “Indians are incapable of responsibility.” ডাঃ আজিজ মারাবার পাহাড়ে সফল ভ্রমণ পরিকল্পনার মাধ্যমে শাসকদের ঐ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত করতে বদ্ধপরিকর। ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষে “Anglo-Indian” পরিচিতির প্রচলন ঘটে। ব্রিটিশ শাসকবর্গ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ঐ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের অমানবিক আচরণ ও নিষ্ঠুরতার কারণে “Anglo-Indian” পরিচিতিটি ক্রমে ভারতীয়দের কাছে ঘৃণিত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মানবিক গুণাবলীর কারণে মিসেস মূর ও এ্যাডেলার “Anglo-Indian” এ রূপান্তর আজিজের কাছে অবিশ্বাস্য। মারাবার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ট্রেনে ভ্রমণকালে এ্যাডেলা বিষয়টি উত্থাপন করেন “Well, by marrying Mr. Heaslop. I shall become what is known as an Anglo-Indian” এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন ডাঃ আজিজ: “Impossible. Take back such a terrible remark…. You will never be rude to my people.”

উল্লেখিত আলাপচারিতায় জাতিগত বিদ্বেষ ও সংঘাতের সুর স্পষ্ট। মারাবার পাহাড়ে পৌঁছে গুহা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন মিসেস মূর। কিন্তু গুহার ভয়ঙ্কর শব্দের প্রতিধ্বনি ও পরিবেশে তিনি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। কোনভাবে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেন, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এ্যাডেলা ও আজিজের কাছ থেকে। ইংল্যান্ডে অবস্থানরত ছেলেমেয়ে রাফ ও স্টেলার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্যে পত্র লেখায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ওদিকে একজন পথ প্রদর্শকের সঙ্গে এ্যাডেলা ও আজিজ এক গুহা থেকে অন্য গুহায় ঘুরতে থাকেন।

নিমন্ত্রিত অতিথিকে নতুন কিছু দেখানোর উদ্দেশ্যেই ডাঃ আজিজের সেখানে অবস্থান, যদিও নগর ম্যাজিস্ট্রেটের মত নিষ্ঠুর এক ব্রিটিশের বাগদত্তা হওয়ায় এ্যাডেলার প্রতি তার অনুভূতি নেতিবাচক। ফিল্ডিং-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় এ্যাডেলার অনাকর্ষণীয় দৈহিক সৌন্দর্য সম্পর্কে মন্তব্য ডাঃ আজিজের নেতিবাচক মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে আগেই প্রকাশ করেছিল।

অন্যমনস্কভাবে গুহার মধ্যে ভ্রমণরত এ্যাডেলা ছিলেন মানসিকভাবে পীড়িত। নগর ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। একটি জটিল জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হন এ্যাডেলা। তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন যে রনির প্রতি তাঁর সত্যিকার কোন প্রেম নেই : “What about love? … She and Rony-no, they did not love each other.” l পীড়িত বোধ করেন এই ভেবে যে রনির সঙ্গে প্রেমহীন এক বিবাহ বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হবেন।

এ্যাডেলার দৃষ্টি যায় গুহার অভ্যন্তরের শিলায় অঙ্কিত চিহ্নের দিকে যা অবিকল পদচিহ্নের মত, কয়েকদিন আগেই যেমনটি তিনি দেখেছিলেন রাস্তায় নবাব বাহাদুরের গাড়ীতে রনির সঙ্গে ভ্রমণের সময়। ধূলিময় রাস্তায় গাড়ীর চাকা অমন চিহ্ন এঁকেছিল। রনির পাশে বসে থাকা নিষ্প্রাণ মুহূর্তটি এ্যাডেলার স্মরণে আসে। “Not to love the man one is going to marry ! Not to find it out till this moment!… Ought she to break her engagement off?”

মানসিক এই দ্বন্দ্বের মুহূর্তে এ্যাডেলা নিজেকে ভাবেন ঐ পর্বত আরোহিণীর মত যার নিরাপত্তার দড়ি ছিন্ন হয়েছে। যন্ত্রণাদায়ক এই ভাবনা থেকে মুক্তি পেতে এ্যাডেলা ভিন্ন কিছু করতে চান। ডাঃ আজিজের চোখে ধরা পড়ে এ্যাডেলার ভাবান্তর। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আপনাকে কি বেশী দ্রুত ঘোরাচ্ছি?” এ্যাডেলা জবাব দেন, “না আমি ঠিকই আছি, ধন্যবাদ।”

তারপর ডাঃ আজিজকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি বিবাহিত?” আজিজ জবাব দেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আসুন না আমার স্ত্রীকে দেখতে।” মুহূর্তের জন্য স্ত্রীকে জীবিত কল্পনা করতে ভাল লাগে। আজিজের। এরপর আলোচনায় আসে আজিজের সন্তানদের কথা; এ্যাডেলার ধারণা হয়, স্বগোত্রীয় মেয়েরা নিশ্চয়ই আজিজের প্রতি আকৃষ্ট। আর তখনই দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার অনুধাবন “neither she nor Ronny had physical charm.”

ব্যক্তিগত জীবনের বিপর্যয়কর ভাবনার মধ্যে সহসা তাঁর মনে পড়ে মুসলমানদের বহু বিবাহ সম্পর্কিত মিসেস টারটনের ভাষ্য। এ্যাডেলার মনে হল। “Probably this man had several wives-Mohammedans always insist on their full four.” অদম্য এক কৌতূহলে এ্যাডেলা আজিজকে জিজ্ঞাসা করেন : “Have you one wife or more than one?” আকস্মিক এই প্রশ্নে ডাঃ আজিজ দারুণ অপ্রস্তুত ও আহত বোধ করেন : “But to ask an educated Indian Moslem how many wives he has-appalling, hideous!” এই মুহূর্তে এ্যাডেলাকে অন্য Anglo-Indian দের মতই তাঁর মনে হয়, কারণ ভারতীয়দের ব্যঙ্গ বিদ্রূপেই তারা উৎসাহী।

ব্যাপারটি ডাঃ আজিজের কাছে অধিক যন্ত্রণাদায়ক এই কারণে যে তাঁর স্ত্রীর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পরও দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের প্রস্তাব তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ডাঃ আজিজ তাঁর মানসিক স্বস্তি কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলেন এবং তা ফিরে পেতে নিকটবর্তী এক গুহায় তিনি ঢুকে পড়েন। “Damn the English even at their best” কথাটি তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারণ করেন তিনি। এ্যাডেলা এত বেশী আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে ডাঃ আজিজের চলে যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটে যায় তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে।

এ্যাডেলার আচরণে ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতি সুপ্ত ক্রোধে ফেটে পড়লেও কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত হন ডাঃ আজিজ এবং ফিরে আসেন আগের ঐ গুহায়। কিন্তু পথ-প্রদর্শক জানায়, এ্যাডেলা তখন অন্য গুহায় ভ্রমণে ব্যস্ত। কমপক্ষে বারটি গুহার কোনটিতে এ্যাডেলা রয়েছেন তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। ডাঃ আজিজ পথ প্রদর্শককে চিৎকার করে ডাকতে বলেন, কিন্তু পথ প্রদর্শক জানায়, তা হবে অর্থহীন, কারণ মারাবার গুহায় বাইরের কোনো শব্দ পৌঁছে না। প্রচণ্ড আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হন ডাঃ আজিজ, ঘামে ভিজে ওঠে তাঁর সমস্ত শরীর।

সহসা ফিল্ডিং এসে পৌঁছান সেখানে এবং জানান এ্যাডেলাকে একটু আগেই দেখা গেছে অতিথিদের সঙ্গে। স্বস্তি ফিরে পান ডাঃ আজিজ, যদিও কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে চরম অবমাননাকর এক পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে ফরস্টারের ভাষ্য : “The racial problem can take subtle forms. In their case it had induced a sort of jealousy, a mutual suspicion.” ফিরতি ট্রেনে চন্দ্রপুর পৌছার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ইনস্পেকটর মিঃ হক ট্রেনের কামরায় ঢুকে চিৎকার করে বলেন : “Dr. Aziz, it is my highly painful duty to arrest you.” সকলেই হতবাক।

ফিল্ডিং প্রতিবাদ করে ওঠেন, ভাবেন নির্ঘাৎ কোনো ভুল হয়েছে, দেখতে চান গ্রেফতারী পরোয়ানা। পুলিশ কর্মকর্তা নির্বিকার, জানালেন যে গুরু অপরাধে তিনি গ্রেফতার করতে এসেছেন তাতে গ্রেফতারী পরোয়ানার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় ডাঃ আজিজ স্তম্ভিত। গ্রেফতারের পরিণতিতে নিজের ও সন্তানদের সম্ভ্রমহানির কথা ভেবে তিনি ব্যাকুল। সহসা তিনি ট্রেনের বিপরীত দরজা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফিল্ডিং ও অন্যান্যদের সাহায্যের আশ্বাসে ধরা দেন।

পরে জেলা কালেক্টরের মুখে ডাঃ আজিজের অপরাধ এ্যাডেলাকে গুহার মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার কথা জেনে ফিল্ডিং বুঝতে পারেন জাতিগত বিদ্বেষের এ এক পাগলামী : “He felt that a mass of madness had arisen and tried to overwhelm them all.” শাসক জাতির একজন হয়েও শাসিত এক ভারতীয়ের পক্ষে কথা বলার কারণে ফিল্ডিং-এর প্রতি কটূক্তি করা হয় নির্বিচারে।

ব্রিটিশ শাসনের জালে আবদ্ধ ভারতীয়দের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব যে কতটা বিদ্বেষমূলক তা বোঝা যায় ডাঃ আজিজকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর কর্মতৎপরতায়। আজিজের নৈতিক অধঃপতন প্রমাণের জন্য কোর্টে উপস্থাপন করা হবে আজিজের বন্ধুর এক চিঠি, যাতে আজিজের কোলকাতার পতিতাদের সঙ্গে মিলিত হবার প্রসঙ্গ রয়েছে। অধঃপতনের আরো প্রমাণ হিসেবে আজিজের ড্রয়ার থেকে পুলিশের লোকেরা এক রমণীর ছবি উদ্ধার করে।

ফিল্ডিং ছবি দেখেই চিনতে পারেন, ওটা আজিজের স্ত্রীর ছবি, যা একদিন তিনি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ সুপার তা অবিশ্বাস করতে বদ্ধ পরিকর : “McBryde gave a faint, incredulous smile… his face became inquisitive and shightly besital ‘wife indeed, I know those wives!” যদিও ডাঃ আজিজ একজন মুসলমান, কিন্তু তাঁর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য একজন ব্রিটিশ বিদ্বেষী হিন্দু আইনজীবী নিয়োগ করার কারণে মামলাটি ব্রিটিশ শাসক ও ভারতীয় শাসিতের সংঘাত রূপে বিবেচিত হতে থাকে।

এই পরিকল্পনায় ফিল্ডিংয়ের সায় নেই, কারণ মামলার মূল উদ্দেশ্য ডাঃ আজিজকে নির্দোষ প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত করার পরিবর্তে তা শাসক-শাসিতের সংঘাতকেই উস্কে দেবে। “Fielding demurred; this seemed to be going to the other extreme. Aziz must be cleared but with a minimum of racial hatred …” চন্দ্রপুরের শাসকদের মনোভাবে এটা সুস্পষ্ট যে মামলাটির মাধ্যমে বিদ্বেষী ভারতীয়দের একহাত দেখে নেয়ার চমৎকার এক সুযোগ তারা পেয়েছে, আর নবাগত এ্যাডেলাই সে সুযোগ এনে দিয়েছেন।

মারাবার গুহায় আসলে কি ঘটেছিল অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ফরস্টার তা প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। তবে এ্যাডেলার আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে তিনি মানসিক ভ্রান্তির (hallucination) শিকার ছিলেন। রনির সাথে তাঁর প্রেমহীন বিয়ে তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে তোলে। এটা যেন অনেকটা জোরপূর্বক দৈহিক মিলন অর্থাৎ ধর্ষণের পর্যায়ভুক্ত। বিষয়টি নিয়ে এ্যাডেলা যখন গভীরভাবে ভাবছিলেন ঠিক তখনি তাঁর ফিল্ড গ্লাসের ধাক্কা লাগে গুহার দেয়ালে।

আশঙ্কা হয় কেউ যেন তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। যেহেতু তাঁর সঙ্গে একমাত্র ডাঃ আজিজই গুহার মধ্যে রয়েছেন, এ্যাডেলা ভ্রান্তির শিকার হন যে নারীসঙ্গ বিবর্জিত ডাঃ আজিজই তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। আর ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষ ও সংঘাতের কারণেই শাসকগোষ্ঠী অবলীলাক্রমে তা সত্য বলে মেনে নেয়। ইতিমধ্যে এ্যাডেলা কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু তা ব্রিটিশদের হতাশ করে, কারণ এ্যাডেলার দীর্ঘ অসুস্থতা মামলায় জয়ী হবার সহায়ক।

এমনকি সিভিল সার্জনও এ্যাডেলার সুস্থতায় ক্ষুব্ধ : “He appeared to resent his patient’s recovery. ….” শাসকগোষ্ঠী প্রচার করে যে হিন্দু অধ্যাপককে ঘুষ দেয়া হয়েছিল সকালের প্রার্থনা দীর্ঘায়িত করতে যাতে ফিল্ডিং ট্রেনে উঠতে ব্যর্থ হন এবং মিসেস মূর ও এ্যাডেলার সহযাত্রী না হতে পারেন। তারা এমন কথাও বানিয়েছিল যে গুহায় মিসেস মূরকে হত্যার জন্য ডাঃ আজিজ একদল স্বদেশীকে ভাড়া করেছিলেন অর্থের বিনিময়ে, উদ্দেশ্য এ্যাডেলাকে নিয়ে পালানো।

শাসকদের মনোভাবে ফিল্ডিং এতই ক্ষুব্ধ যে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন: “I believe Dr. Aziz to be innocent. If he is guilty I resign from my service and leave India….”

মামলা চলাকালীন সময়ে সংঘাত এতটা তুঙ্গে ওঠে যে ব্রিটিশদের নিরাপত্তা জোরদার করার বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হয়। মামলার শুরুতেই ডাঃ আজিজের আইনজীবী একটি আপত্তি উত্থাপন করেন যা কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করে। একজন হিন্দু বিচারককে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব দিয়েছেন মামলা নিষ্পত্তির, উদ্দেশ্য একজন ভারতীয় বিচারক দ্বারা অপর এক ভারতীয়কে দন্ডিত করা, কিন্তু নিজেরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা।

একজন হিন্দু ভারতীয় বিচারক কর্তৃক একজন মুসলমান ভারতীয় দণ্ডিত হবার পরিণতিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সম্ভাবনা বিরাট এবং তেমন কোন পরিস্থিতি যেন ব্রিটিশ শাসকদের কাম্য। মামলা চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বিশেষ মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। আইনজীবীর আপত্তির কারণে বিচারক ন্যায় বিচারের স্বার্থে ঐ বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান থেকে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাধারণ আসনে বসার নির্দেশ দেন।

উপস্থিত ভারতীয় জনতা এটা তাদের বিজয় ভেবে উল্লাস ধ্বনি উচ্চারণ করে। এ্যাডেলা কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালে জনতা মিসেস মূরের সাক্ষ্য গ্রহণের দাবী জানায়। ডাঃ আজিজের প্রতি মিসেস মূরের সহৃদয়তার পরিচয় জেনে নগর ম্যাজিস্ট্রেট ইতিমধ্যেই তাঁর মাকে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেন। জাহাজে যাত্রাপথে বৃদ্ধার মৃত্যু ঘটে। অশিক্ষিত জনতার কণ্ঠে মিসেস মৃর “Esmiss Esmoor”-এ রূপান্তরিত হয় এবং ক্রমাগত ঐ ধ্বনি এ্যাডেলার ওপর এক মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে।

সহসাই এ্যাডেলা সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তিমুক্ত হন এবং প্রকৃত ঘটনা অনুধাবন করে তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন: “Dr. Aziz never followed me into the cave.” তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে ব্রিটিশ শাসকরা মরিয়া হয়ে ওঠে।

জেলা কালেক্টরের ইঙ্গিতে সিভিল সার্জন মামলা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে : “I stop these proceedings on medical grounds.” এ্যাডেলা জোর গলায় বলে ওঠেন : “I withdraw everything,” কিন্তু সিভিল সার্জন তাকে তিরস্কার করে জিজ্ঞাসা করেন: “Are you mad?” মামলার পরিসমাপ্তিতে ও ডাঃ আজিজের সম্মানজনক মুক্তিতে শাসকগোষ্ঠীর সকলেই মর্মাহত। শুধুমাত্র ফিল্ডিং উল্লসিত তাঁর বন্ধুর ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে।

অন্যদিকে রনির সঙ্গে এ্যাডেলার বাগদান ভেঙ্গে যায়। এ্যাডেলার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে চান ডাঃ আজিজ, কিন্তু ফিল্ডিং তাতে বাদ সাধেন। বেচারী এমনিতেই অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁকে আবার আর্থিক জরিমানায় জড়ানো কেন। জাতিগত বিদ্বেষ এই সাধারণ ব্যাখ্যাকে জটিল করে তোলে। ডাঃ আজিজ ভাবেন, এ্যাডেলার প্রতি ফিল্ডিংয়ের এই পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তিস্বার্থ লুকিয়ে থাকবে। হয়ত ফিল্ডিং নিজেই এ্যাডেলাকে বিয়ের কথা ভাবছেন। ডাঃ আজিজের এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত।

উপন্যাসের শেষাংশে দেখি ব্রিটিশ শাসনে বিক্ষুব্ধ ডাঃ আজিজ চলমান সংঘাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য দূরে অন্য কোথাও চলে যেতে চান “I have decided to have nothing to do with British India. shall seek service… where English man cannot insult me any more.” পরবর্তীতে ডাঃ আজিজ রাজা শাসিত ভারতীয় হিন্দুরাজ্যে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন কালেও বিস্মৃত হতে পারেননি ব্রিটিশ শাসকদের অবজ্ঞাসূচক আচরণ। তাদের প্রতি তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের প্রকাশ ঘটে রাল্‌ফের চিকিৎসাকালে তার প্রতি রূঢ় আচরণে।

ডাঃ আজিজ জানতেন না মৌমাছির কামড়ে আহত তাঁর রোগী রাল্ফ মিসেস মূরের ছেলে, যে ভারতীয় ঐ রাজ্যে বেড়াতে এসেছে তার ভগ্নীপতি ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে। রাল্ফ যখন মিসেস মূরের নাম উচ্চারণ করে, এক অনাবিল তৃপ্তিতে ভরে ওঠে ডাঃ আজিজের মন। মুহূর্তেই কেটে যায় তাঁর সকল তিক্ততা। তবে ফিল্ডিংয়ের মুখোমুখি হবার পরও আগের সেই বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতা আর ফিরে আসে না। উপন্যাসের সমাপ্তিতে দেখি ডাঃ আজিজ ও ফিল্ডিংয়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। ডাঃ আজিজের ক্রুদ্ধ উচ্চারণ “Down with the English anyhow. That’s certain. Clear out, you fellows… we hate you most… we shall drive every blasted Englishman into the sea and then … you and shall be friends.”

লক্ষণীয়, সমকালীন রাজনীতি ও সংঘাত তাদের বন্ধুত্বের পথে প্রধান অন্তরায়। যতদিন ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখবে ভারতবর্ষে, ততদিন ঐ তিক্ততা থাকবেই। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেই বন্ধুত্ব হবে ডাঃ আজিজ ফিল্ডিংয়ের মধ্যে। ফিল্ডিংয়ের মত ফরস্টারও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর একজন হয়েও এই রূঢ় সত্য ও বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তাঁর কালজয়ী এই উপন্যাসে।

সহায়ক গ্রন্থ:

  • লিওনেল ট্রিলিং E. M. Forster, নরফোক, কানেকটিকাট : New Directions, নরফোক, কানেকটিকাট, ১৯৬৪ ।
  • জুন পেরী লেভিন : “E. M. Forster’s A Passage to India: Creation and Criticism,” Disstertation Abstracts, XXVIII (১৯৬৮), 3189A-3190A
  • গারট্রুড এম. হোয়াইট : A Passage to India: Analysis and Revaluations, Twentieth Century Inerpretations of A Passage to India, সম্পদনায় Andrew Rutherford, Englewood Cliffs, Prentice, ১৯৭০।
  • আর্নল্ড কেল: E. M. Forster: A Passage to India, পুনর্মুদ্রিত Twentieth Century Inerpretations of A Passage to India, সম্পদনায় Andrew Rutherford, নিউ জার্সি: Englewood Cliffs, Prentice, ১৯৭০।
  • ই. এম. ফরস্টার : A Passage to India, নিউ ইয়র্ক : Harcourt, ১৯২৪।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment