রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ – মুস্তাফা নূরউল ইসলাম : আমাদের জন্য বর্তমান প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ-বিচিত্র কত ক্ষেত্রে তাঁর বিস্ময়কর সৃজনশীল কর্মগুলো এবং সেই সঙ্গে বিশেষ আরো কিছু কথা। বলব, বছরে বছরে যে রবীন্দ্রজয়ন্তী, তা প্রাত্যহিকতার স্থূল দাবিপীড়িত সাধারণ আমাদের কাছে ওই অবকাশটা এনে দেয়। তখন আমরা তাঁর নিকট হওয়ার প্রয়াস পাই; নানা জিজ্ঞাসার অবতারণা করতে আগ্রহী হয়ে উঠি।
[ রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ – মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ]
জানা সত্যটার এবং উত্তরপুরুষকে জানিয়ে দেওয়ার সত্যটার অবতারণা করা যাক। কী প্রকারে আজকের এই বাংলাদেশ? রাজনৈতিক মানচিত্রের বিশেষ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এবং এক সার্বভৌম সত্তা নিয়ে যে এই দেশটির অভ্যুদয়, জীবিত রয়েছেন সবারই তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এতদঞ্চলের মানুষ সেই সময় কেমন জীবনতুচ্ছ প্রাণিত প্রেরণায় দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিল।
মরণজয়ী অভিযান বাঙালির ঠিকানার সন্ধান। সেদিন সাত কোটি সন্তান সেটি জেনে গিয়েছিল; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। আর সেই সঙ্গে কোটি কণ্ঠে গগণবিদারী শপথ উচ্চারণ ‘জয় বাংলা’। ইতিহাসের পালাবদল ঘটেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং অর্জনের ফসল মেঘনা-যমুনার বাঙালির বাংলাদেশ।
এখানে এখন ওই প্রসঙ্গ-রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ; কিংবা আরেকভাবে বলা যেতে পরে, বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ। স্মরণ করি, আমাদেরই তো কৈশোরের যৌবনের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ কাল গেছে, যখন রাজনৈতিক প্রতিরোধ সংগ্রামের সমান্তরাল সম্পূরক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তীব্রতা তুঙ্গে। সেই সময় সবটা মিলিয়ে বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধনে অপ্রতিরোধ্য প্রেরণার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথে-নজরুলে। ইতোমধ্যে বেশিদিনের কথা তো নয়, তখন রবীন্দ্রনাথে-নজরুলে-বাংলাদেশে একাকার মেশামিশি হয়ে আমাদের চেতনাকে এক নতুন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল করে তুলেছিল।
আমরা নির্ভয় হয়েছিলাম বারবার আমাদের উচ্চারণ-ভয় করব না, ভয় করব না। অতঃপর একষট্টিতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। দুর্গম দুঃসাহসী কঠিনের সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে গেল। প্রত্যক্ষ এবং অন্তরালের গভীরে এভাবে কাজ করে যায় প্রেরণার হোমমন্ত্র। এ আমাদেরই আপন অভিজ্ঞতা। যুগে যুগে, দেশে দেশে ইতিহাস তা-ই বলে।
না, যথার্থ যে জন্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথ আজকের বাংলাদেশের কোনো ভৌগোলিক ঠিকানার নন, যেমন নন নজরুল। আরও অবশ্যই তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা নন-মহাত্মা গান্ধীর ন্যায়, কি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের ন্যায়, কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ন্যায়। তথাপি তিনি রবীন্দ্রনাথ, প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশ। তাঁর ভাণ্ডার থেকেই তো চয়ন করে নিয়েছি জাতীয় সংগীত: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এটা অবশ্য একেবারে শেষের কথা, তত দিনে আমরা পৌঁছে গেছি সার্বভৌমত্বে গরিমান্বিত, মুক্ত বাংলাদেশের ঠিকানায়। কিন্তু প্রারম্ভ পর্বে?
বলছি, রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন। পর্যটক-অভিযাত্রীর কর্মকাণ্ড নয়। কৌতূহলী সেই মানুষ, সংবেদনশীল চিত্তের, ক্রমেই উদ্ঘাটিত হচ্ছে অপরূপ বাংলাদেশের হৃদয় তাঁর চেতনায় এবং তিনি চিনিয়ে দিচ্ছেন-এই তো বাংলাদেশ, পদ্মাচরের ‘কী নিভৃত পাঠশালা’। বর্ণনার গ্রাফিক রেখাঙ্কন নয় মোটে, ভালোবাসার ভাষায়, ‘সূর্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারদিক যে কী সুন্দর হয়ে উঠল, সে আর কী বলব!
বহু দূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল-নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে এল-মনে হলো, ওইখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি…।’ স্থান পতিসর ভায়া আত্রাই। পুনরায়, সাহাজাদপুরের ছবি: ‘খুব উঁচু পাড় বরাবর দুই ধারে গাছপালা লোকালয়-এমন শান্তিময়, এমন সুন্দর, এমন নিভৃত, দুই ধারে স্নেহ-সৌন্দর্য বিতরণ করে নদীটি বেঁকে বেঁকে চলে গেছে-আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরচারিণী নদী।
আরও পড়ুন: