ইসাবেলের আত্ম অন্বেষণ

ইসাবেলের আত্ম অন্বেষণ : ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকান লেখক হেনরী জেমসের অন্যতম প্রধান উপন্যাস The Portrait of a Lady-র একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণ। ইসাবেল আরচার হচ্ছেন নিজ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রোমান্টিক এক আমেরিকান তরুণী, যাঁর পোর্ট্রেট অঙ্কিত হয়েছে এই উপন্যাসে। ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণের অনুঘটক হচ্ছে তাঁর প্রচণ্ড আত্ম-সচেতনতা।

The Portrait of a Lady
The Portrait of a Lady

উপন্যাসের শুরুতেই দেখি লন্ডনের উপকণ্ঠে গ্রীষ্মের এক অপরাহ্নে আমেরিকান ব্যাঙ্কার মি. টুশেট অভিজাত ব্রিটিশ লর্ড ওয়ারবারটনকে চা চক্রে আপ্যায়িত করছেন। আলাপচারিতায় বলছেন, তাঁর স্ত্রী মিসেস টুশেট অচিরেই আমেরিকা থেকে তাঁর ভাগ্নী ইসাবেলকে নিয়ে ফিরবেন। তাঁরা হাস্যরসে মেতে ওঠেন এই মন্তব্যে যে আমেরিকান তরুণীরা মূলত স্বামীর অন্বেষণে ইউরোপ ভ্রমণ করে থাকে।

[ ইসাবেলের আত্ম অন্বেষণ ]

মি. টুশেট কৌতুকভরে লর্ড ওয়ারবারটনকে সতর্ক করে দেন, তিনি যেন আগত তরুণীর প্রেমের জালে জড়িয়ে না পড়েন। লন্ডনে হৃদয়ের উষ্ণতায় অভ্যর্থনা জানানো হয় ইসাবেলকে। সবাই মুগ্ধ হয় তাঁর সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বে। তবে তাঁর আত্মসচেতনতা ও নিজ স্বাধীনতার ব্যাপারে আপোষহীনতা সবার চোখে পড়ে। লর্ড ওয়ারবারটন মুগ্ধ হন ইসাবেলের আচরণে।

উপন্যাসের চতুর্থ অধ্যায়ে ইসাবেলের পোর্ট্রেট ক্রমেই স্পষ্ট রূপ নেয়। আমরা জানতে পারি, অন্যান্য বোনের তুলনায় ইসাবেল কিছুটা অস্থির প্রকৃতির। কল্পনাপ্রবণ এই তরুণীর জীবনে এখন পর্যন্ত কোন ব্যর্থতা বা বিপর্যয় ঘটেনি।

জীবনে ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ের কথা সাহিত্য পাঠেই তিনি জেনেছেন। পড়াশোনায় ইসাবেলের তেমন মন নেই এবং ইউরোপ ভ্রমণে লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছে। ইসাবেলের প্রেমিক ক্যাসপার গুডউড তাঁকে বিয়ে করতে চায়, তবে এ ব্যাপারে তেমন ভাবনা নেই ইসাবেলের। বিয়ের আগে অন্য অনেক পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর ভাবনায়। লন্ডনে অবস্থানরত হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে পড়ুয়া ইসাবেলের খালাতো ভাই রাফ বুঝতে পারে ইসাবেলের আত্মসচেতনতা ও স্বাধীনচেতা মনোভাব।

The Portrait of a Lady
The Portrait of a Lady

অসুস্থ রাল্‌ফ মনে প্রাণে সমর্থন করে ইসাবেলের মন-মানসিকতা। সে সবসময় আনন্দমুখর থাকার পরামর্শ দেয় তাঁকে। ইসাবেলের ভাষ্য: সে উদ্দেশ্যেই ইউরোপ ভ্রমণে আসা। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে ইংল্যান্ড সম্পর্কে ইসাবেলের ধারণা অত্যন্ত রোমান্টিক। মি. টুশেট তাঁকে অতি-রোমান্টিকতার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। এদিকে ইসাবেলের খালা মিসেস টুশেট ইংল্যান্ডের সব ব্যাপারেই সমালোচনামুখর আর ইসাবেলের ভূমিকা ঠিক বিপরীত।

লর্ড ওয়ারবারটনের প্রাসাদ ভ্রমণের পর ইসাবেল কিছুটা উৎসাহ প্রকাশ করেন এই অভিজাত ব্রিটিশের ব্যাপারে। কিন্তু মি. টুশেট তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন এই বলে, যে লর্ড ওয়ারবারটনকে তাঁর ধ্যান-ধারণার জন্য শুধু করুণাই করা যায়, ভালবাসা যায় না। আর আত্মসচেতন ইসাবেল নিজ স্বাধীনতায় হস্ত ক্ষেপের আশঙ্কায় লর্ড ওয়ারবারটনের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যান। ইসাবেলের সাংবাদিক বন্ধু হেনরিয়েটা পেশাগত কাজে লন্ডনে আসে এবং ইসাবেলকে জানায়, ক্যাসপার এখনও তাঁকে প্রচণ্ড ভালবাসে এবং শুধু ভালবাসার টানেই সে ইংল্যান্ড এসেছে।

হেনরিয়েটা অনুযোগ করে যে ইসাবেল বেশ পাল্টে গেছে এবং আচার আচরণে ইউরোপীয় হয়ে উঠছে। এদিকে লর্ড ওয়ারবারটন হঠাৎ উপস্থিত হয়ে ইসাবেলকে তাঁর ভালবাসার কথা বলেন। অকপটে স্বীকার করেন, প্রথম দর্শনেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন ইসাবেলের প্রতি। কিন্তু ইসাবেলের প্রতিক্রিয়া সতর্ক। তাঁর ধারণা, মুক্ত জীবনযাপনের যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণ, তা ব্যাহত হতে পারে এই প্রস্তাবে সাড়া দিলে।

The Portrait of a Lady
The Portrait of a Lady

পরামর্শের জন্য ইসাবেল মি. টুশেটের শরণাপন্ন হন। খালুর পরামর্শে কিছুটা উৎসাহ থাকলেও মুক্ত জীবনের অন্বেষণে ইসাবেল লর্ড ওয়ারবারটনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ক্যাসপারের ব্যাপারেও তাঁর মনোভাব নেতিবাচক। ক্যাসপারের চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ কিছুই পছন্দ নয় ইসাবেলের। হঠাৎ করেই একদিন ক্যাসপার দেখা করতে আসে ইসাবেলের হোটেল কক্ষে। তিরস্কার করে ইসাবেল তাকে ফিরিয়ে দেন। নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে ইসাবেল এক ধরনের তৃপ্তি লাভ করেন : লর্ড ওয়ারবারটন ও ক্যাসপার দুজনেই তাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত।

ইসাবেলের আত্মত্ম-অন্বেষণের প্রেক্ষাপটে অষ্টাদশ অধ্যায়ে মাদাম মারলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মিসেস টুশেটের বান্ধবী রহস্যময়ী মাদাম মারলের সঙ্গে প্রথম আলাপচারিতায় বিশেষভাবে মুগ্ধ হন ইসাবেল। এদিকে মি. টুশেট রালফকে পরামর্শ দেন ইসাবেলকে বিয়ে করতে। কিন্তু ইসাবেলের স্বাধীন জীবনের দর্শনে বিশ্বাসী অসুস্থ রালফ এ প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বাবাকে অনুরোধ করে তাঁর নিজের জন্য দলিল করা সম্পত্তির অর্ধেক ইসাবেলকে দান করতে, যাতে সে মুক্ত জীবনযাপন করতে পারে।

এদিকে, মাদাম মারলের রুচিবোধ, সৌন্দর্যজ্ঞান ও শিল্পসম্মত আচরণে ইসাবেল দারুণ উৎফুল্ল ও প্রবলভাবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। হেনরিয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্বের অপূর্ণতা যেন পূর্ণতা লাভ করে মাদামের সঙ্গে বন্ধুত্বে। মি. টুশেটের মৃত্যুর পর সত্তর হাজার পাউন্ডের সম্পত্তি পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক ইসাবেল। এখন তাঁর ভাবনা, হঠাৎ করে পাওয়া এই ক্ষমতা কিভাবে ব্যবহার করা যায়। অচিরেই খালার সঙ্গে প্যারিস যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় ইসাবেলের ইউরোপ ভ্রমণ।

The Portrait of a Lady
The Portrait of a Lady

ফ্লোরেন্স যাবার পথে স্যান রেমোতে অসুস্থ রাফের সঙ্গে দেখা হয় ইসাবেলের। তিনি জানতে চান তাঁর সম্পত্তি লাভের রহস্য। প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত রাল্‌ফ স্বীকার করে ইসাবেলের সম্পত্তি লাভের ব্যাপারে তার নিজের ভূমিকা। এত টাকা ব্যবহারের স্বাধীনতার কথা ভেবে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন ইসাবেল। কিন্তু রাল্‌ফ তাঁকে আশ্বস্ত করে বলে, এসব কিছু পরিচালনার যোগ্যতা রয়েছে তাঁর।

ইসাবেলের ইটালী অবস্থানকালে উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয় গিলবার্ট অসমন্ডকে ঘিরে, যার ব্যাপারে মাদাম মারলে ইতিমধ্যেই ইসাবেলকে অবহিত করেছেন, তাঁকে উৎসাহিত করেছেন অসমন্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। উপন্যাসের দ্বাদশ অধ্যায়ে আমরা অসমন্ডকে দেখি, কনভেন্ট স্কুল থেকে দুজন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে ফিরে আসা একমাত্র মেয়ে প্যানসিকে স্বাগত জানাতে।

একটু পরেই সেখানে উপস্থিত হন মাদাম মারলে এবং প্যানসি বাগানে গেলেই তিনি অসমন্ডকে বলেন তাঁর আমেরিকান বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করতে। অসমন্ডের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। কিন্তু যখন মাদাম বিস্তারিতভাবে বলেন যে ইসাবেল

সুন্দরী, ধনী, সার্বজনীন, বুদ্ধিমতী আর তুলনাহীনভাবে গুণবতী,

তখন অসমন্ড উৎসাহ বোধ করে ইসাবেলের ব্যাপারে। ইসাবেলের অসমস্ত দর্শন ঘটে দূর থেকে, কিছুটা লাজুকভাবে তিনি অসমন্ডকে দেখেন। মাদাম মারলের সঙ্গে তার ভিলায় আমন্ত্রণ জানায় অসমস্ত। ইসাবেল কিছুটা দ্বিধান্বিত, কারণ রালূফের কাছে অসমস্ত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শুনেছেন তিনি।

উপন্যাসের চতুর্বিংশতি অধ্যায়ে আমরা দেখি অসমন্ডের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইসাবেল পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ভিলায় মাদাম মারলের সঙ্গে উপস্থিত হন। অসমন্ডের বোন কাউন্টেস জেমিনির সঙ্গে ইসাবেল পরিচিত হন সেখানে। সেখানকার রহস্যময় পরিবেশ ভাল লাগে ইসাবেলের। অসমন্ডের শিল্পানুরাগী মন ও বিভিন্ন সংগ্রহ তাঁকে চমৎকৃত করে। নিজের জীবন সম্পর্কে খোলামেলা সব বলে যায় অসমন্ড।

চমৎকৃত ইসাবেলের মনে হয়, অসমন্ড যেন ইটালী সম্পর্কে তাঁর সকল কল্পনার প্রতীক; সৌন্দর্যের পূজারী ও অফুরন্ত জ্ঞানের ধারক। সংগ্রহের রোমান্টিক জিনিসগুলি যেন অসমন্ডের সৌন্দর্য ও জ্ঞানের কথাই বলে। প্যানসির ভবিষ্যৎ নিয়েও তাদের মধ্যে কথা হয়। অসমস্ত পুলকিত বোধ করে এই ভেবে যে মাদাম মারলের মন্তব্য যথার্থ : ইসাবেল উপযুক্ত পাত্রীই বটে। তবে সে কিছুটা চিন্তিত এই ভেবে যে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গুণবতী ইসাবেলকে নিজ ধ্যান-ধারণাকে বিসর্জন দিতে হবে। ইসাবেলের ইতিহাসপ্রিয়তা তাঁকে নিয়ে যায় রোমের ঐতিহাসিক মনুমেন্ট দর্শনে।

The Portrait of a Lady
The Portrait of a Lady

হঠাৎ করেই দেখা হয় সেখানে লর্ড ওয়ারবারটনের সঙ্গে। আলাপচারিতায় ব্রিটিশ লর্ড ইসাবেলকে স্মরণ করিয়ে দেন তাঁর বিয়ের প্রস্তাবের কথা। আগের মতই তা প্রত্যাখ্যান করে ইসাবেল বলেন, লর্ড ওয়ারবারটনের ব্যাপারে তিনি ভীত। সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রাল ভ্রমণের সময় হঠাৎ করেই অসমন্ড এসে হাজির। তার প্রতি গুণমুগ্ধতায় ইসাবেল মন্তব্য করেন, অসমন্ডের পোপ হওয়া উচিত ছিল। উচ্ছ্বসিত অসমন্ডের জবাবঃ

ওটা আমি ভালভাবেই উপভোগ করতাম।

রোমে অবস্থানকালে ইসাবেল অনেকটা সময় অসমন্ডের সঙ্গে কাটান। তাদের ভ্রমণ স্মরণীয় করতে অসমন্ড একটি সনেট লিখে ইসাবেলকে উপহার দেয়। সে ধীর শান্তভাবে কথা বলে এবং নিজের চেয়ে প্যানসির কথাই বেশী বলে। ইসাবেলকে বশ করার এটা তার এক অপকৌশল ।

ইতিমধ্যে কেটে গেছে একটি বছর। ইসাবেলের ইউরোপ ভ্রমণ চলছে দুর্বার গতিতে। নিউইয়র্ক থেকে বড় বোন লিলি এসেছে পাঁচ মাসের সফরে। ইসাবেল তাকে নিয়ে ভ্রমণ করেন প্যারিস, লন্ডন ও রোম। পরবর্তীতে তিন মাসের ভ্রমণে মাদাম মারলেকে সঙ্গে নিয়ে যান গ্রীস, তুরস্ক ও মিশরে। এই সময়ের অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণে ইসাবেল বুঝতে পারেন মাদাম মারলের সঙ্গে তাঁর নিজের চিন্তা চেতনার দূরত্ব অনেক বেশী। সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক অবস্থান ও নৈতিক পরিবেশে মাদাম মারলের জীবনযাপন।

ইসাবেলের এই ত্বরিত ভ্রমণ আসলে তাঁর অস্থির চিত্তেরই বহিঃপ্রকাশ। অসমন্ডের ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌছুতেই ইসাবেলের এই অস্থিরতা। একসময় কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি আসে ইসাবেলের জীবনে। অসমন্ডের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েই চিঠি লেখেন ক্যাসপারকে জানিয়ে দেন তাঁর সঙ্গে অসমন্ডের আসন্ন বাগদানের সিদ্ধান্ত। মিসেস টুশেট ইসাবেলের সিদ্ধান্তের কথা জেনে প্রবল আপত্তি জানান, তিরস্কার করেন ইসাবেলকে। কিন্তু ইসাবেলের এক কথা

নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের।

ইসাবেলের এই প্রচণ্ড আত্মসচেতনতা বোধ তাঁর জীবনে যে ট্র্যাজেডীর সূত্রপাত করছে সে ব্যাপারে ইসাবেল ছিলেন অসচেতন। এখানেই ইসাবেল চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা। শিল্পকর্ম সংগ্রাহক অসমন্ড তাঁকেও যে সংগ্রহের এক শিকারে পরিণত করেছে ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণ তা উদঘাটনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ইসাবেলের শুভাকাঙ্ক্ষী মরণাপন্ন রাল্ফ অকপটে জানায়, ইসাবেল জীবনে ধরা খেয়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছে অসমন্ডের কাছে।

এদিকে অসমন্ড প্রচণ্ড আনন্দিত যে মাদাম মারলে তাকে এমন একটা উপহার দিয়েছেন যা অনেকটা অমূল্য রূপোর থালার মত। নিজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলনের জন্য আকর্ষণীয় সুন্দরী এই তরুণীর তার খুবই প্রয়োজন। ইসাবেলের সৌন্দর্য, গুণাবলী ..আর অর্থ সবই অসমন্ড ভালবাসে।

অবশেষে ইসাবেলের সঙ্গে অসমন্ডের বিয়ে হয় রোমে। সাদামাটা ভাবেই শেষ হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। রাল্‌ফ প্রচণ্ড আহত বোধ করে ইসাবেলের অবিবেচক সিদ্ধান্তে; তবু বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। মাদাম মারলে এক অজুহাতে এড়িয়ে যান বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের পর থেকে ইসাবেল মাদাম মারলের সঙ্গ লাভে বঞ্চিত, কারণ মাদামের অবস্থান রোম থেকে দূরে কোথায়ও। সহসা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেন ইসাবেল।

Pride and Prejudice
Pride and Prejudice

মাদাম আর অসমন্ডের নিকটতম বন্ধু নেই, মাদামকে কাছে বিব্রত বোধ করে অসমন্ড। ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণে একটা বিষয় পরিষ্কার যায় অসমন্ডের সঙ্গে বিয়েটা মস্ত বড় হয়েছে। কিন্তু তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছেন এমনটি ভাবতে একেবারেই তাঁর স্বাধীনভাবেই তিনি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে তাঁর জানতে দারুণ আগ্রহ : কি ছিল সেই ব্যাপারটা যা তাঁকে এই করেছে?

ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক পর্বটি ঘটে অচিরেই। একদিন প্যানসিকে নিয়ে লং ড্রাইভে শহর থেকে দূরে গিয়েছিলেন ইসাবেল। ফিরে এসে দেখেন অসমন্ডের সঙ্গে কথা বলছেন মাদাম মারলে। এক চকিত দৃষ্টিতেই ইসাবেল বুঝতে পারেন ওদের দুজনের মধ্যে এমন অন্তরঙ্গতা রয়েছে যা ওরা ইসাবেলের কাছে লুকাতে চায়। কিছুদিনের মধ্যেই ক্রুদ্ধ অসমন্ডের স্বরূপ প্রকাশিত হয়। লর্ড ওয়ারবারটন ইসাবেলের কারণেই প্যানসির সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ট আচরণ করেন।

অসমন্ডের ধারণা, লর্ড ওয়ারবারটন প্যানসিকে পছন্দ করেন। সুতরাং তার দাবী ইসাবেলকে তাঁর প্রতি লর্ড ওয়ারবারটনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ লর্ডের সঙ্গে প্যানসির বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অসমন্ডের সঙ্গে মাদাম মারলের ইচ্ছেও তাই। আত্মসচেতন ইসাবেলের কাছে ব্যাপারটি অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। অসমন্ডের সঙ্গে তাঁর আজকাল প্রায়ই বাকবিতণ্ডা হয়। মাঝে মধ্যে সামান্য যে আলাপচারিতা হয় তাও নিষ্প্রাণ ও বিদ্বেষপূর্ণ।

অসমন্ড ও মাদাম মারলের মনোভাব জানার পর ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণ আরো প্রবলভাবে জেগে ওঠে। একাকী ড্রইংরুমে বসে ইসাবেল তাঁর বিয়ের ব্যাপারটি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণে মগ্ন হন। অসমন্ডের স্বার্থন্বেষী মনোভাব ও মাদাম মারলের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তাঁকে পীড়িত করে। বিভিন্ন পর্যায়ে স্বামীর প্রতি অবিশ্বাস তাঁকে যন্ত্রণা দেয়। সহসা তাঁর মনে হয়, অসমন্ড তাঁকেই ঘৃণা করে। অসমন্ড সম্পর্কে তাঁর এতদিনের সব ধারণাই ভুল।

ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণ
ইসাবেলের আত্ম-অন্বেষণ

স্বামীর ইচ্ছেমত চলতে হলে ইসাবেলকে তাঁর নিজস্ব সব বিশ্বাস ও ধারণাকেই ত্যাগ করতে হবে। তাঁর নিজস্ব একটা মন আছে, আছে চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা এটাই যেন তাঁর বড় অপরাধ। ইসাবেল যেন অসমন্ডের সুন্দর বাগানের মূল্যবান এক সম্পদ। এত টানাপোড়েন সত্ত্বেও ইসাবেল ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক তাঁর স্বামীকে; কারণ তাহলে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হবে।

আর নিজের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে এমনটি ইসাবেলের ভাবনার অতীত । ইসাবেলের বিশ্বাস, নিজ কর্মের ফল নিজেকেই ভোগ করতে হবে। সহসা তাঁর মনে পড়ে অসমন্ডের বোন জেমিনির বক্তব্য : মাদাম মারলে আসলে প্যানসির মা। অসমন্ডের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল তাদের। মানসিক যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত ইসাবেল বুঝতে পারেন, মাদাম মারলের চক্রান্তের অসহায় শিকার তিনি।

Quenton Anderson তাঁর সমালোচনা গ্রন্থ The American Henry James-এ লিখেছেন, জেমসের উপন্যাসে ইসাবেলের সচেতনতা একটি বাস্তব সত্য: “চরিত্ররা দেখে, অনুভব করে এবং অনুধাবন করে সচেতনতার

মাধ্যমে, ” জেমসের এই উপন্যাসে ইসাবেলের সচেতনতা তাঁর চারদিকের পৃথিবীকে সংজ্ঞায়িত করে। আধুনিক লেখকরা সর্বজ্ঞাত ও সর্বদ্রষ্টার ভূমিকা থেকে সরে এসে চরিত্রের সচেতনতাকে কাহিনী বিন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছেন, যেমনটি ঘটেছে এই উপন্যাসে। অপর এক সমালোচক Juliet MacMaster তাঁর “The Portrait of Isabel Archer” প্রবন্ধে লিখেছেন, কাহিনী বিন্যাসের প্রক্রিয়ায় “লেখক তার সৃষ্টির ভেতরে, পেছনে, বাইরে অথবা উপরে অদৃশ্যভাবে অবস্থান করেন।

তিনি নিজে অস্তিত্বহীনভাবে পরিশুদ্ধ ও উদাসীন থাকেন।” The Portrait of a Lady উপন্যাসে আমরা লক্ষ্য করি, লেখকের কর্তৃপক্ষীয় বর্ণনামূলক কণ্ঠস্বর কাহিনী বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই স্তিমিত হয়ে আসে। উপন্যাসের সঙ্কটময়কালে আমরা দেখি শুধু ইসাবেলের গভীর অনুধাবন, যা তাঁর সচেতন মনের ভাবনার ফসল। আমরা যতই ইসাবেলকে প্রত্যক্ষ করি, তাঁকে দেখি ক্রমাগত আত্মসচেতনতায় মগ্ন হতে। Henry James’s American Girl: The Embroidery of the Canvas গ্রন্থে Virginia Fowler-এর এই মন্তব্য যথার্থ।

 

সহায়ক গ্রন্থ

হেনরী জেমস The Portrait of a Lady, বস্টন: Houghton Miffin, ১৯৬৮।

কোয়েনটন এন্ডারসন : The American Henry James, নিউ জার্সি : Rutgers University Press, ১৯৫৭।

জুলিয়েট ম্যাকমাস্টার : “The Portait of Isabel Archer, American Literature 45, ১৯৭৩।

ভার্জিনিয়া ফাউলার : Henry James’s American Girl : The Embroidery on the Canvas মেডিসন : University of Wisconsin Press, ১৯৮৪।

 

আরও পড়ুন:

নারীবাদী উপন্যাসে মিসেস বেনেট

Leave a Comment